গল্প- এক বর্ষায়

এক বর্ষায়
– অমিত কুমার জানা

 

2008 সালের আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহ। সারা সপ্তাহ জুড়ে ঝির ঝির বৃষ্টি ঝরছিল। নারায়ণপুর গ্ৰামের খাল -বিল সবই জলে থৈ থৈ করছিল। সেই বৃষ্টিতেই রবি খেলার মাঠে পাড়ার বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলায় মেতে ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে বল খেলার যে অনাবিল আনন্দ তা বোধহয় পনের বছরের রবি ভালো করেই জানে।
কর্দমাক্ত মাঠের উপর ছেলেরা ফুটবল খেলছিল এবং গড়াগড়ি খাচ্ছিল। এমন সময় রবির মা বহুছিদ্রবিশিষ্ট একটি ছাতা মাথায় নিয়ে রবিকে ডাকতে ডাকতে মাঠে চলে এলেন এবং বললেন, “এখনই ঘরে চল, বৃষ্টিতে আর ভিজিস না, শরীর খারাপ হবে। তোর দাদা এইমাত্র বাড়ি এসেছে।” রবির দাদা রঘু পড়াশোনা সূত্রে খড়গপুর শহরে থাকে। দাদার কথা শোনামাত্র রবি খেলা ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় লাগাল রুদ্ধশ্বাসে। তার বাকি খেলার সঙ্গীরা কর্দমাক্ত শরীরে দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো মাঠের পার্শ্ববর্তী কপালেশ্বরী খালে। বছরের অন্যান্য সময়ে এই ছোট্ট নদীটি শুকনো থাকলেও এই বর্ষার মরসুমে বেশ স্রোতস্বিনী হয়ে ওঠে।

বৃষ্টি স্নাত কর্দমাক্ত রবি বাড়ি ফিরে এল। প্রায় মাসতিনেক পর তার দাদা শহর থেকে বাড়িতে এসেছে। রঘু কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বহু দিন পর দুই ভাইয়ের সাক্ষাৎ হলো। এমনিতে ছেলেবেলায় দু’জনের একেবারেই বনিবনা হতো না, কিন্তু এখন তারা অনেকটাই পাল্টে গেছে। সন্ধ্যার দিকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। রবির মা খানিক চিন্তিত হয়ে বললেন, “এবারও বন্যা হবে না তো! ওরকম যেন আর না হয়…” এই বলে ঠাকুরের নাম করলেন। রাত্রি নয়টা নাগাদ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। লোডশেডিং, বাড়িতে কেবল হ‍্যারিকেনের আলো। বাড়ির বাইরে বর্ষার প্রকৃতি নিকষ কালো আঁধারে একেবারে আচ্ছন্ন।
এদিকে বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রবি নিদ্রাচ্ছন্ন। ঘুমন্ত অবস্থায় পায়ের যন্ত্রণায় ছটকাচ্ছে। তার মা এসে বকুনি শুরু করলেন- “কতবার বলেছি বর্ষায় খেলতে যাস না..তোকে নিয়ে আর পারলাম না…তোকেও কোথাও বাইরে দিয়ে আসবো।”
এই বলে তিনি রবির পায়ে বাটাহলুদ সহ গরম তেল লাগিয়ে দিলেন। ছেলের ছোটখাটো দুষ্টুমি সব মায়েরাই তো প্রশ্রয় দেয়।

সকালে যখন সবার ঘুম ভাঙলো রবিরা দেখতে পেল কপালেশ্বরীর জল দু’কূল ছাপিয়ে তাদের বাড়ি থেকে ষাট-সত্তর ফুট দূরে থাকা আমগাছটার তলদেশ স্পর্শ করেছে। পাড়াপ্রতিবেশীরা আসন্ন বন্যার অশনিসংকেত পেয়ে তার কারণ এবং ভবিতব্য কুফল সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিল। কেউ কেউ বললো যে কপালেশ্বরী দীর্ঘদিন সংস্কার না করার জন্যই এই দুরবস্থা।
এদিকে টিভি এবং রেডিওর আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুসারে বৃষ্টি থামবার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং সময়ের সঙ্গে উপর্যুপরি মুষলধারে বৃষ্টি হতে লাগলো। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া।

দুপুরের দিকে রবির মা রান্নার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আসন্ন বিপদের অনুভূতির ছাপ তাঁর চোখে মুখে স্পষ্ট পরিলক্ষিত হলো। তিনি বড়ছেলে রঘুকে পাঠালেন কিছু মশলা বাজার করে আনতে। রঘু তাদের সেই পুরানো বহুছিদ্রবিশিষ্ট ছাতাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অর্ধসিক্ত শরীরে রঘু পৌঁছে গেল অনতিদূরের বাদলদার ভূসিমাল দোকানে। সেখানে আচমকা দেখা হয়ে গেল তার হৃদয়াকাঙ্খিত স্বপ্নসুন্দরী পিয়ালীর সঙ্গে। সেই স্কুলজীবন থেকেই রঘু মনে মনে পিয়ালীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। পিয়ালীও এটা জানে। কিন্তু উভয়পক্ষ থেকেই পরস্পরের প্রতি এখনও মৌখিকভাবে কোন প্রেম নিবেদন হয় নি। স্কুলের পড়া শেষ করে রঘু শহরে চলে গেল, আর পিয়ালী এখনও নারায়ণপুর গ্ৰামেই থাকে। পিয়ালী এতক্ষণ বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু থামেনি। সে রঘুর হাতে ছাতাটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো রঘুকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলবে কিনা। এদিকে রঘুও ভাবছিল যদি সে পিয়ালীকে তার ছত্রতলে সযত্নে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারতো! শেষমেশ রঘুই তার ছাতার তলে পিয়ালীকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলো এবং যখন তারা পৌঁছাল দু’জনেই বৃষ্টির জলে ভিজে একাকার। পিয়ালী তার মিষ্টি মুচকি হাসিতে রঘুকে বিদায় জানালো। রঘু বাজার করে বাড়ি ফিরলো। তার হৃদয়ে তখন বৃষ্টি ভেজা প্রেমের শিহরণ।

দুপুর দু’টো নাগাদ কপালেশ্বরীর জল রঘুদের মাটির বাড়ি স্পর্শ করলো। জলের উচ্চতা বাড়তে লাগলো খুব দ্রুত। রঘুর মা, বাবাসহ সবাই ঘরের বিশেষ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং মূল্যবান কাগজপত্র গোছাতে শুরু করলো। বাড়িতে মজুত চাল, মুড়ির টিন ইত্যাদি একে একে নিয়ে যাওয়া হলো গ্ৰামের সবচেয়ে উঁচু স্থান সেই হাইস্কুলে। গবাদি পশুদের দড়ি খুলে দেওয়া হলো, তারা সাঁতরে পার হয়ে গেল বন্যার জল। কিন্তু আটকা পড়লো একটি দুগ্ধপোষ্য ছোট্ট বাছুর। সে এখনও সাঁতার শেখে নি। রবি তাকে ঘাড়ে তুলে বেশ কষ্টে প্লাবিত জল অতিক্রম করে স্কুল মাঠে নিয়ে এলো।
সন্ধ্যা নাগাদ কপালেশ্বরীর তীরবর্তী সমস্ত মানুষ জন ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিল স্কুলটিতে।

ক্রমশ জলস্তর বেড়েই চলেছে। একটা একটা করে মাটির ঘর ভেঙে পড়ছে। নিকষ আঁধার থেকে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে অসহায় কুকুরের আর্তনাদ। কয়েকটা ভাগ্যবান কুকুর জল বিপদসীমা অতিক্রমের পূর্বেই আশ্রয় নিয়েছিল স্কুলমাঠে। বাকিরা বোধহয় বন্যার স্রোতে বেপাত্তা। স্কুল বারান্দায় কয়েকটা লম্ফ এবং হ্যারিকেনের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। বাইরের কালো আঁধারেও দিগন্ত বিস্তৃত বন্যার জলের অস্তিত্বে সবার বুক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠছিল। মাঝেমধ্যে শেয়ালের বেসুরো ডাক ভেসে আসছিল, সঙ্গে ঝিঁঝি পোকার অসহ শব্দ। সব মিলিয়ে বন্যার সেই রাতটা ভয় এবং আশঙ্কায় রহস্যময়ী হয়ে উঠেছিল।

পরেরদিন সকাল হতে না হতেই রবি এবং রঘুর মা তৎপর হয়ে সর্বাগ্ৰে পৌঁছালো তাদের সেই মাটির কাঁথের বাড়িটা দেখতে। কিন্তু, একি! রবির মা নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকলেন। তাঁর দু’চোখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রুধারা ফোঁটায় ফোঁটায় বন্যার জলে মিশে যাচ্ছে। সেখানে তাদের বাড়ির কোন অস্তিত্ব ছিল না। ভেঙে পড়া বাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল বিক্ষুব্ধ কপালেশ্বরীর সর্বগ্ৰাসী জলপ্রবাহ। বাড়ির প্রায় সমস্ত জিনিসপত্র, বই, খাতা, আসবাব তখন জলের তলে তলিয়ে গেছে কিংবা ভেসে কোথায় চলে গেছে। রবি এবং রঘু মাকে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, “বন্যার জল সরে গেলে এখানেই তো আমরা আবার ছিটাবেড়ার ছোট্ট বাড়ি বানাবো। “

Loading

Leave A Comment